Criminals are being caught in the army-police operation

নাছির উদ্দিন শোয়েব : ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিছুদিন পর থেকে হঠাৎ পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটতে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানে বাড়তে থাকে খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবারীসহ বিভিন্ন অপরাধ। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনীর কিছুটা নিষ্কিয়তার সুযোগে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। থানায় পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ ও টহল না থাকায় অপরাধীরা এ সুযোগটিকে কাজে লাগায়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় দ্রুত অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। 

এরই মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি স্থানে বড় ধরনের কয়েকটি অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটে। সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরে একটি বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারকৃত কয়েকজনের পরিচয় নিশ্চিত হয় র‌্যাব ও পুলিশ। এতে দেখা যায়-সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাবেক কয়েকজন সদস্য মিলে গড়ে তোলা চক্রটি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এছাড়াও আরও কয়েকটি দুর্ধর্ষ অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে মোহাম্মদপুরে। প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা। দিনেদুপুরে অস্ত্র ঠেকিয়ে পথচারীর টাকা নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকীরা। এরপর নতুন করে ঢাকাসহ সারাদেশে অপরাধীদের পাকড়াওয়ে বিশেষ অভিযান শুরুর নির্দেশ দেয়া হয় পুলিশ সদর দফতর থেকে। আগে থেকেই চলমান বিশেষ অভিযানকে জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল হোসেন। এই অভিযানের মধ্যেই মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত সন্দেহে গত তিন দিনে ১০৮ জনকে গ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

পুলিশ অবশ্য বলছে পাঁচই আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে। কিন্তু তারা এখন মনে করছেন পুলিশ বাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং ঢাকাসহ সারাদেশে পুলিশী কার্যক্রম স্থিতিশীল হওয়ায় এখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধ চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে। যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র‌্যাব ছাড়াও সেনাবাহিনী এখনো মাঠে আছে বলে জানানো হয়েছে এবং তারা আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার আন্দোলনের সময় সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব ঘটনায় অনেক থানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর হয়েছে। আগের সরকারের সময়ে আলোচিত বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আর কাজেই যোগ দেননি। বেশ কিছু পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়েছে। সাবেক দুই আইজিপিসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মামলায় আটকও করা হয়েছে। এরপর বাহিনীকে পুনর্গঠন ও কার্যকরী করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি এখনো হয়েছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করেন অনেকে।

গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকার অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য এবং প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা নিয়ে আক্রমণ কিংবা দৌড়াদৌড়ির মতো বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বা মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে- এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ। সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনাই মোহাম্মদপুর এলাকার। ওই এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলছেন, পাঁচই আগস্টের পর কয়েকদিন ছিলো ডাকাতির আতঙ্ক আর এখন কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধভাবে কিশোর তরুণরা ঘুরাঘুরি করছে, একে ওকে হামলা করছে এবং ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না। এর আগে গত ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতির ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো। সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরা ডাকাতেরা নিজেদের যৌথ বাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে নগদ ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করেছিলো বলে ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছিলেন। এ ঘটনায় আট জনকে আটক করা হয়েছে। সব মিলিয়ে কিশোর গ্যাং আর ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিলো এলাকাটি। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী এ ঘটনায় থানার সামনে বিক্ষোভে ও ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়ার পর শনিবার রাতে এলাকাজুড়ে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী। আবার ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় হামলা, লুটপাট, ডাকাতি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুই জনকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ। নীলফামারীর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্রঋণের ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হতেই ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি। ফরিদপুরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরের ব্রাক্ষ্মণকান্দা এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে কনস্টেবলসহ দুজনকে পিটুনি দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে রিফাত মিয়া নামের অটোরিকশা চালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া গত পাঁচই আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। এ সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরে এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় যৌথ বাহিনীর পৃথক তিনটি অভিযানে সর্বশেষ সোমবার ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে গত দুই দিনে (শনি ও রোববার) মোহাম্মদপুর থেকে ৭৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জানান, গত রাতে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে সাত জনকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি রিভলবার, ২০ রাউন্ড গুলী ও ৫টি চাপাতি উদ্ধার করা হয়। পৃথক অভিযানে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুই কেজি গাঁজা, দুটি সামুরাই, একটি চাপাতি, একটি ছুরি ও একটি অটোরিকশা জব্দ করা হয়। এছাড়া মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে ডাকাতি মামলায় তিন জন সক্রিয় ডাকাত সদস্য, দস্যুতা মামলায় পাঁচ জন, চুরি মামলায় তিন জন পেশাদার চোর এবং ডিএমপি অ্যাক্টে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। মোহাম্মদপুরে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান এআইজি সাগর।

বিশেষ অভিযান জোরদার করার নির্দেশ: গত সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক(আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম সন্ত্রাসী, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, কিশোর গ্যাং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযান জোরদার করতে পুলিশের সকল ইউনিট প্রধানদের প্রতি নির্দেশ দেন। পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশব্যাপী ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান বিশেষ অভিযানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামীসহ অন্যান্য মামলার আসামীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশী টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল পেট্রোল ও মোটরসাইকেল পেট্রোল টিম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও মোবাইল চেকপোস্ট কার্যকর রয়েছে। ৩০০টি মোটর সাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে। এছাড়া, দেশব্যাপী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধেও মামলা, গ্রেফতারসহ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া চলমান রয়েছে। চলমান বিশেষ অভিযানে রোববার পর্যন্ত ২শ’ ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, ডাকাত, ১৬ জন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে হামলার অভিযোগে ১ হাজার ১৪০ জন, মাদকদ্রব্য উদ্ধার সংক্রান্ত ঘটনায়  ১হাজার ১৪৪ জন, এবং ৫৫ জন অবৈধ অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Some more such news

EN