অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করেন। তিনি সরকারের ভুল-ত্রুটি নির্দ্বিধায় ছাপতে বলেছেন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্র মেরামত করা জন্য মস্ত বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশকে নতুন শিখরে নেয়ার জন্য এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তবে এর জন্য জাতীয় ঐক্যের খুব প্রয়োজন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টাকে তারা বলেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার যেন যৌক্তিক সময় পর্যন্ত থাকেন। এই যৌক্তিক সময় আসলে কতটা সময়- সে বিষয়ে ড. ইউনূস সম্পাদকদের কাছে জানতে চান। এই সময়টাতে কী কী মৌলিক কাজ সরকারের করা উচিত- এ বিষয়েও পরামর্শ চান তিনি। সম্পাদকদের দেওয়া প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরে শফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন রকম কথা এসেছে যেমন- অন্তত ২ বছর মেয়াদ দেওয়া যেতে পারে। অনেকে আবার দুই থেকে তিন বছরের কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে যতটা সময় লাগে তা দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব দেন।’
শফিকুল আলম বলেন, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে বেশির ভাগই বলেছেন, যেসব সংস্কার কাজ বা যে কর্মপরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে, সেটিই আসলে নির্ধারণ করবে এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে।
বৈঠকে সম্পাদকদের পক্ষ থেকে আসা পরামর্শ তুলে ধরে প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন, সংবিধান পুনর্লিখন, আইন কমিশন, সংবিধান কমিশন, মিডিয়া কমিশন ও পুলিশ কমিশন গঠনের কথা এসেছে। পুলিশকে আরো কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায় এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের কথা এসেছে।’
এদিকে আলোচনা শেষে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, আমাদের কাছে ওনার আবেদন হচ্ছে, আমরা যেন লিখনির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের সাজেশান্স উনি সাদরে গ্রহণ করেছেন। আমাদের বলেছেন, সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি হলে আমরা যেন নির্দ্বিধায় কাগজে ছাপি। ওনার সরকারকে সহযোগিতা করি।
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারি বাসভবন যমুনায় পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সভায় দেশের প্রথম সারির ২০টি দৈনিকের সম্পাদকেরা উপস্থিত ছিলেন। তবে ২২ জন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও দুজন দেশের বাইরে অবস্থান করায় অংশ নিতে পারেননি বলে জানা গেছে। বৈঠক শেষে যমুনার গেটে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডে সম্পাদকেরা একাত্মতা পোষণ করেছেন বলে জানান মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক। সেখানে আমি একজন সম্পাদক হিসেবে যেটা উত্থাপন করেছি, সেটা হচ্ছে, সাংবাদিকদের নিশ্চয়তা এবং তাদের ব্যাপারে যেভাবে যত্রতত্র খুনের মামলা হচ্ছে সেটা যাতে বন্ধ হয় এবং সরকার যেন সুস্পষ্ট অবস্থান নেন। সাংবাদিকদের যদি দোষ থাকে, তারা যদি দুর্নীতি করে থাকে তাহলে আলাদা মামলা হতে পারে। কিন্তু এইভাবে (ঢালাও খুনের মামলা) যেন না হয়। আলোচনায় জাতীয় ঐক্যের কথা উঠে এসেছে জানিয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে একটা জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত জাতি যেন ঐক্য স্থাপন করতে পারি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সম্পাদকেরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করেন জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো আছে- দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশনকে পুর্নগঠন করে সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থায় পরিণত করা। ভবিষ্যতে সমস্ত নির্বাচনে জাতির এবং ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটান এমন নির্বাচন কমিশন চায়। দেশে যে দুর্নীতি হয় সেটা যেন স্বাধীনভাবে দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়।
ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, উনি একটা ভাইব্রেন্ট মিডিয়া চান। আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। মিডিয়াবান্ধব সরকার যদি কখনো থেকে থাকে তাহলে আমরা এখন পেয়েছি। এর জন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।
সব কালো কানুন বাতিল করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে যতগুলো কালো আইন রয়েছে, (যেমন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট) এ ধরনের আইনের বিষয়ে যাতে এ মুহূর্তে ঘোষণা করা যেগুলোতে সাংবাদিকদের নিপীড়নের অধ্যায় রয়েছে সেগুলোকে কার্যকর করা হবে না এবং এটার পুর্নগঠন ওনারা সময় নিয়ে করবেন।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহফুজ আনাম বলেন, উনি বলেছেন, এটা তার সরকারের পলিসিগত (সাংবাদিকদের নামে মামলা) না। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে যে আলোচনা উঠেছে সেই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে একটি বিশেষ কমিটি করে দিয়ে সবধরনের আইনের পরিবর্তন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পুলিশ পুনর্গঠন-এগুলো বিভিন্নভাবে হতে পারে। অর্থাৎ আমরা পরিবর্তন চাই। এগুলোর আমরা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন চাই।
সরকারের মেয়াদ কতদিন থাকবে তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, সরকারের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সেটা প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জিজ্ঞেস করেছেন। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু মূলকথা যেটা এসেছে সেটা হলো সরকারের এজেন্ডা কী? সেই অনুপাতে সময়। অনেক রাজনৈতিক দল বলেছে, আপনাদের (সরকার) যতদিন দরকার লাগে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে যৌক্তিক সময়। এগুলো তো অস্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টার ইচ্ছা, খবরের কাগজের মাধ্যমে আমরা একটা ধারণা দিই যাতে জাতি কী চায়, কয় বছর হতে পারে, দুই, তিন, পাঁচ বছর। এটা নিয়ে ওনার কোনো নিজস্ব চিন্তা নেই। প্রধান উপদেষ্টা চান জনতার চিন্তাটা জানতে। সেই ব্যাপারে তিনি গণমাধ্যমকে আহ্বান জানিয়েছেন, আমরা যেন গণমাধ্যম হয়ে জনগণের কথা লিখি। মাহফুজ আনাম জানান, প্রধান উপদেষ্টার ধারণা, পৃথিবী এখন বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক এ পরিবর্তনে। তারা চায় বাংলাদেশকে যেভাবে সাহায্য করার দরকার সেটা তারা করবে।
যারা অতীতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেনি তারাও এখন সহযোগিতার আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানান জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এতে দেশটি ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেশটি। বিষয়টি উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, এটা আনন্দের খবর। আমি মনে করি ইউনূস ভাইয়ের মতো একজন নেতা না হলে আন্তর্জাতিকভাবে এটা আসত না। এতে আমরা খুবই খুশি। সরকারি গণমাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস), বিটিভি, বেতারকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পরামর্শ সম্পাদকেরা দিয়েছেন বলে জানান মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, তারা যেন পেশাগতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, সংবাদ সম্পাদক আলতামাশ কবির, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ, কালের কণ্ঠের হাসান হাফিজ, আমাদের সময় সম্পাদক আবুল মোমেন, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, প্রতিদিনের বাংলাদেশের মুস্তাফিজ শফি, দেশ রূপান্তরের মোস্তফা মামুন, কালবেলা সম্পাদক সন্তোষ শর্মা।
এ ছাড়া দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক, দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন, দৈনিক করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।