বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে ঢাকায় চারজনসহ সারা দেশে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অনেকে। গতকাল শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৯ মিনিটে এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর থেকে চারদিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এ সম্পর্কে ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবির জানিয়েছেন নতুন তথ্য। তিনি জানিয়েছেন, গত ৩০ বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি। এর উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদীতে।

তার পরের তথ্যটিতে পরিষ্কার হয়, এ ভূমিকম্পের শক্তিমত্তা কতটুকু। তিনি জানান, এক ভয়াবহ হিরোশিমা, নাগাসাকিতে ফেলা একটি বোমা যে শক্তি রিলিজ করে, আজকের (গতকাল) ভূমিকম্প সেই মাত্রার শক্তি রিলিজ করেছে। এ ভূমিকম্পে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতও কেঁপে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাসহ এর আশপাশে মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ; বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকা। ২০০৩ সাল থেকে ভূমিকম্প নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের মতে, ভূতাত্ত্বিক ও টেকনোটিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। একটা ইন্ডিয়া প্লেট এবং এর পূর্বে বার্মা প্লেট ও উত্তরে ইউরেশিয়ান প্লেট। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। ভূমিকম্প কখনো যদি বাংলাদেশমুখী প্লেটে ঘটে তাহলে এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে সুবিশাল চ্যুতি থাকায় একটি দেশে ভূমিকম্প হলে তার পাশের দেশে যে কোনো মুহূর্তে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। অভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প প্রমাণ করে বাংলাদেশ উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। যার ফলে সিলেট ও চট্টগ্রাম ছাড়াও সবচেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে রাজধানী ঢাকা। এ ছাড়া বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ। এরপর মাঝারি ঝুঁকিতে রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগ। বলা হয়, প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হওয়ার ফলে এ অংশে যে শক্তি জমা রয়েছে, সেটা একসঙ্গে বের হলে ৮ দশমিক ২ স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শক্তি একবারে বের না হয়ে আংশিক বের হলে ভূমিকম্পের মাত্রা হবে কম।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা দেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা লক্ষাধিক। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং এর কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১টি এবং ২০২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৫৩টিতে পৌঁছায়। এটি ছিল গত আট বছরের সর্বোচ্চ। চলতি বছরের গত তিন মাসেই বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে বিভিন্ন মাত্রার ৬০টির বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তাতে মনে করা যায় দেশে ৭ মাত্রার বড় ধরনের ভূমিকম্প ফেরত আসার সময় বেশি দূরে নয়। আর এ ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। অথচ ভবন ধসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার সন্তোষজনক ব্যবস্থা বাংলাদেশে অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা জনবহুল ঢাকা মহানগরীর সরু রাস্তাঘাট, অলিগলি পেরিয়ে ভবন ধস-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভবপর নয়। ভবন ধসের পর স্বাভাবিকক্রমে বিধ্বস্ত হয়ে যায় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো জরুরি ব্যবস্থাগুলো। এসব দ্রুত পুনঃস্থাপনের সামর্থ্য বা প্রস্তুতি কোনোটাই তেমন নেই বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ভবন ধস-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো হয়ে পড়বে কষ্টকর।

উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের মধ্যে হাইতিতে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এবং চিলিতে রিখটার স্কেলে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫২৫ জন নিহত এবং নিখোঁজ হয় ২৫ জন। ভূমিকম্প প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণে চিলিতে এত বড় শক্তিশালী ভূকম্পনের পরও বিদ্যুৎ, টেলিফোন, টেলিভিশন সংযোগ অব্যাহত থাকে। চিলিতে প্রাণহানিও কম হয়েছে সেখানে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের কারণে। ১৯৭৩ সাল থেকে কমপক্ষে ১৩টি ছোট-বড় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চিলিতে ভূমিকম্প মোকাবিলায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক জনসচেতনতা। এমনকি স্কুল, কলেজেও ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ভূমিকম্প-পরবর্তী ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ভূমিকম্প সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ভূমিকম্প শুরু হলে ভবনে বসবাসকারী সবাইকে তাড়াহুড়া না করে বাইরে খোলা স্থানে দাঁড়াতে হবে। বন্ধ করে দিতে হবে ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ। বাইরে বেরোনো সম্ভব না হলে কোনো শক্ত টেবিল, খাট বা ভবনের বিমের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। হাতে টর্চ, পানি ও শুকনো খাবার রাখতে হবে। দেশজুড়ে অঞ্চলভিত্তিক পরিবেশ ও মাটির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ না করা হলে ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয় মোকাবিলা কঠিন হবে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অতি পুরোনো জীর্ণ-শীর্ণ ভবনগুলোকে ভেঙে ফেলতে হবে। যেসব ভবন মোটামুটি বাসযোগ্য মনে হয়, সেগুলোকে রিট্রোফিটিং করে কিছুদিনের জন্য টিকিয়ে রাখা গেলে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রাণহানির সংখ্যা হ্রাস করা যাবে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি অদ্যাবধি বের না হওয়ায় শুধু প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

Some more such news

EN