পদ্মা ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের ৮৭৪ কোটি টাকা উদ্ধারে পথনকশা চেয়েছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পদ্মা ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সভায় পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল উদ্ধারের বিষয়েও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় এক বছর মেয়াদে ৫০৮ কোটি টাকা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়।
মেয়াদ শেষে সুদাসল পরিশোধ না করায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি নবায়ন করা হয়। ওই সময় পর্যন্ত কয়েক দফায় পদ্মা ব্যাংক মাত্র ৮০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সুদ-আসলে আটকে থাকা অর্থ দাঁড়ায় ৫৯৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ আমানতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিভিন্ন সময় ট্রাস্ট অর্থ উঠাতে চাইলে দেয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুদ-আসলসহ ব্যাংকটির কাছে সংস্থাটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৭৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর পদ্মা ব্যাংক উল্লেখযোগ্য অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়।
তারপরও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মতো সরকারি সংস্থাগুলো উচ্চ সুদের প্রলোভন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পদ্মা ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে।
এ অর্থ উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হয়। সভায় এ অর্থ নগদায়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনাপূর্বক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুনিদির্ষ্ট পথনকশা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময় দেশের আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও কোনো ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রিসভা কিংবা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কখনও আলোচনা হয়নি।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ বারবার ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করে এবং চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্যাংক সুদ বা আসল বাবদ কোনো টাকা দেয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও আলোচনা করে অর্থ ফেরত আনার প্রয়োজনীয় উদ্যোগের গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তারপরও পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ এ অবস্থায় কীভাবে এ টাকা ফেরত নেওয়া হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকটির অবস্থা যদিও ভালো না, তবু আমাদের পাওনা অর্থ উদ্ধার করতে হবে। এ জন্য আমরা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে রয়েছি।
আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল আটকে রয়েছে
পদ্মা ব্যাংকে বছরের পর বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ আমানত আটকে থাকলেও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সারাফাত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে নবায়ন সুবিধা নিয়েছেন। তিনি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ফেরত চাওয়ার অনুরোধ আমলে না নিয়ে বছরের পর বছর অর্থ আটকে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা ১৭৯ কোটি টাকা ফেরত পেতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন পদ্মা ব্যাংকে ১০৯ কোটি টাকা জমা করেছিল। ২০১৮ সালের মধ্যে সুদ বেড়ে সেই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ কোটি টাকা। তখন থেকে আমানত নগদায়নের জন্য পদ্মা ব্যাংককে ৩১টি চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পায়নি জীবন বীমা করপোরেশন।
২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে পদ্মা ব্যাংকে ৫৩ কোটি টাকা এফডিআর রাখে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটিও বাধ্য হয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী, ধাপে ধাপে পরিশোধের শর্তে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এফডিআর নবায়ন করেছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনেরও (বিটিআরসি) ২৫ কোটি টাকার এফডিআর আটকে আছে এ ব্যাংকে।
পদ্মা ব্যাংক কেলেঙ্কারি
যাত্রা শুরু করার তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচনায় আসে পদ্মা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ অনিয়মের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়, যার বড় অংশ এখন খেলাপি।
এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিস্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত দু’জন ২০১৭ সালের নভেম্বরে পদত্যাগে বাধ্য হন।
২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারে তৎপর হয় সরকার। এর অংশ হিসেবে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।
তবে বিনিয়োগের পর থেকে ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসান করায় রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ পায়নি। উল্টো এসব অর্থের বিপরীতে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করছে বিনিয়োগকারী তিন ব্যাংক ও আইসিবি।