কয়েক মাসের উত্তেজনাপূর্ণ বিরামহীন প্রচারণার পর কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণে ভোট দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। গতকাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ভোটে বড় ধরনের কোনো অঘটন বা সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভোটে ট্রাম্প হেরে গেলে তাঁর সমর্থকরা সহিংসতা ঘটাতে পারে। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর রাজধানী ওয়াশিংটনে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে তাঁর সমর্থকরা। তারা দেশটির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে তাণ্ডব চালায়।
কয়েক দশকের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হলেও চিরাচরিত রীতি অনুসারে আজ বুধবার সকালে ফলাফল মিলবে কিনা, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফল প্রকাশে কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচনে চার বছরের জন্য যিনিই জয়ী হোন, তার প্রভাব পড়তে পারে কয়েক প্রজন্মের ওপর।
কমলা শ্রমজীবী পরিবারের জন্য খাদ্য ও আবাসন ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নিয়ে সীমান্ত বন্ধ করা এবং নাগরিকদের ট্রিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া ফ্লোরিডার পাম বিচে ভোট দিয়েছেন। পরে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি খুব আত্মবিশ্বাস বোধ করছি এবং মনে হচ্ছে রিপাবলিকানরা শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। আমি শুনেছি, আমরা খুব ভালো করছি।’
ট্রাম্প বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি পরাজয় স্বীকার করতে প্রস্তুত। এখন পর্যন্ত আমি মনে করি, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। কমলা হ্যারিস জানান, তিনি গত সপ্তাহে মেইলের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন।
নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস কিংবা রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনিই জিতুন না কেন, তা দেশটিতে ইতিহাস রচনা করবে।
কমলা জয়ী হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী, কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশিয়ান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। আর সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জয়ী হলে তিনি হবেন দেশের ইতিহাসে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট।
দুইবার অভিশংসিত একজন প্রেসিডেন্টও হবেন ট্রাম্প। তা ছাড়া পুনর্নির্বাচনের প্রথম চেষ্টায় হেরে যাওয়ার পর ট্রাম্পই হবেন হোয়াইট হাউসে ফেরা ইতিহাসের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট।
এদিন মার্কিন নাগরিকরা শুধু প্রেসিডেন্টকে বেছে নেননি, তারা মার্কিন কংগ্রেসের উভয় পক্ষের সদস্য নির্ধারণেও ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে সিনেটের ১০০ সদস্যের মধ্যে ৩৪ এবং প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবক’টিতে ভোট হয়েছে। পাশাপাশি ১১টি রাজ্যের গভর্নর এবং অনেক স্থানে স্থানীয় নির্বাচনেও ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচনের দিনের আগেই ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন। এবার যুক্তরাষ্ট্রে মোট ২৪ কোটি ৪০ লাখ ভোট দেওয়ার যোগ্য নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে কতজন ভোট দেন, তা অবশ্যই দেখার বিষয়। বিজয়ী প্রার্থী আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন।
সাত রণক্ষেত্র রাজ্যের সর্বশেষ ভোটের তথ্য
ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে শেষ জরিপে নেভাদা, জর্জিয়া, উত্তর ক্যারোলাইনা ও অ্যারিজোনায় ট্রাম্প সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। উইসকনসিন ও মিশিগানে সুবিধাজনক অবস্থানে কমলা। সবচেয়ে বড় রণক্ষেত্র পেনসিলভানিয়ায় তারা সমানে সমান।
এ জন্য কমলা ও ট্রাম্প যথাক্রমে পেনসিলভানিয়া এবং মিশিগানে গিয়ে প্রচারাভিযান শেষ করেছেন। সাতটি দোদুল্যমান রাজ্যের মধ্যে এই দুটি এবারের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে বলে বিবিসি উল্লেখ করেছে।
পেনসিলভানিয়ার মহামূল্যবান ১৯টি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে। ২০২০ সালে এ রাজ্যে বাইডেন জয় পান। মিশিগানে ১৫টি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে। কয়েক দশক ধরে মিশিগান তথাকথিত ‘নীল প্রাচীর’ রাজ্যের অংশ ছিল। মানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য নির্ভরযোগ্য দুর্গ ছিল। তবে ২০১৬ সালে এখানে ট্রাম্প জয়ী হলে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। অবশ্য গত নির্বাচনে এখানে বাইডেন জয়ী হন।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট রয়েছে। বিজয়ী হতে কোনো প্রার্থীকে ২৭০ বা এর বেশি ভোট পেতে হয়। সাতটি রণক্ষেত্র রাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট রয়েছে ৯৩টি।
শেষ সমাবেশে দুই প্রার্থীর ভাষণ
কমলা হ্যারিস পেনসিলভানিয়ার সমাবেশে জানিয়েছেন, তিনি ‘শক্তি, আশাবাদ, আনন্দের সঙ্গে’ তাঁর প্রচারণা শেষ করতে চান। মঞ্চে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন অপরাহ উইনফ্রে এবং লেডি গাগা।
কমলা বলেন, ‘জোয়ার আমাদের পক্ষে।’ তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং কখনও ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলব, যেখানে আমরা জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনব।’
তিনি করপোরেট কর বাড়ানো এবং শ্রমিক, মধ্যবিত্ত পরিবার, ছোট ব্যবসার কর কমানো; বয়স্কদের জন্য বাড়িতে সেবার খরচসহ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমানোর অঙ্গীকার করেন। সমাবেশে জনতার ঢল নামে।
ট্রাম্প তাঁর বক্তৃতায় উপস্থিত জনতাকে প্রশ্ন করেন– তারা এখন চার বছর আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন কিনা। তাঁর এই প্রশ্নের বিপরীতে র্যাালিতে উপস্থিত জনতা উচ্চ স্বরে না-সূচক জবাব দেন।
এরপর ট্রাম্প বলেন, ‘আজ রাতে আপনাদের এবং সব আমেরিকানের প্রতি আমার খুব সহজ বার্তা– আমাদের এমনভাবে বেঁচে থাকতে হবে না।’
কমলা হ্যারিসকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি ট্রাম্প। তিনি কমলাকে ‘একজন উগ্র বামপন্থি পাগল’ বলে মন্তব্য করেছেন।
বোমা মারার হুমকি নির্বাচনকর্মীর
বোমা মারার হুমকি দেওয়ায় জর্জিয়া রাজ্যে নিকোলাস উইমবিশ নামে এক নির্বাচনকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওপর বোমা হামলার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো এবং এফবিআইর কাছে মিথ্যা বয়ান দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জর্জিয়ার ফুলটন কাউন্টির অন্তত পাঁচটি ভোটকেন্দ্রে বোমা থাকার গুজব শোনা গেছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেখানে বোমার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। হুমকির কারণে এই সুইং স্টেটে প্রায় আধা ঘণ্টার জন্য দুটি স্থান খালি করে দেওয়া হয়েছিল।
আটলান্টার কাউন্টি শহরের কর্মকর্তারা এখন ভোটের সময় সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাড়াতে আদালতে আবেদন করেছেন।
এর আগে পেনসিলভানিয়ার ক্যামব্রিয়ায় প্রযুক্তিগত কারণে কিছু সময়ের জন্য ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। সেখানেও কিছু সময়ের জন্য ভোটের সময়সীমা বাড়াতে আদালতের আদেশের জন্য আবেদন করেছেন কর্মকর্তারা।
কখন জানা যাবে কে জিতেছে এটা বলা কঠিন। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময় ভোট গ্রহণ শুরু ও শেষ হয়। তবে হাওয়াই এবং আলাস্কা বাদে বাংলাদেশ সময় আজ সকাল ১০টার মধ্যে সব রাজ্যে ভোট গ্রহণ হয়ে যাবে। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, বিজয়ীর নাম জানতে কয়েক ঘণ্টা শুধু নয়; কয়েক দিন লেগে যেতে পারে।
ফলাফল প্রকাশে প্রারম্ভিক বিলম্ব বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। একজন প্রার্থী সশরীরে ভোটে প্রথম দিকে এগিয়ে থাকলেও পোস্টাল এবং অন্যান্য আগাম ভোট গণনার পর তিনি পিছিয়ে পড়তে পারেন। এটি ২০২০ সালে মিশিগানে ঘটেছিল। ট্রাম্প সশরীরের ভোটে প্রাথমিকভাবে এগিয়ে থাকলেও পরে বাইডেন তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। মূলত এটা কিছুটা অপেক্ষার খেলা বলে মন্তব্য বিবিসির।
এ রকম ক্ষেত্রে আজ সকালেই ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতে পারেন। তবে ভোট গণনায় তা প্রভাব ফেলবে না। সব ভোট গণনার পর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। অবশ্য বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের ট্রেন্ড দেখে মার্কিন টিভি স্টেশন বিজয়ী প্রার্থীর নাম যে কোনো সময় ঘোষণা করতে পারে। গত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয় চার দিন পর।
রাশিয়ার হস্তক্ষেপের চেষ্টার অভিযোগ মার্কিন গোয়েন্দাদের
নির্বাচনে রাশিয়াসহ ‘প্রতিপক্ষ’ দেশগুলো হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার তারা বলেছেন, ওই দেশগুলো নির্বাচন নিয়ে জনগণের আস্থা নষ্ট করতে চায়।
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, প্রতিপক্ষ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষ দেশগুলো আমেরিকানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয় ওডিএনআই এবং সাইবার ও অবকাঠামো নিরাপত্তা সংস্থা যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি করে।
‘ঘরের মেয়ে’ কমলার জন্য প্রার্থনা ভারতের তামিলনাড়ুতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের আদি নিবাস যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে।
সেখানে কমলার পিতৃপুরুষের গ্রাম থুলাসেন্দ্র পুরমে চলছে পূজা-অর্চনা-প্রার্থনা। মন্দিরে পূজা দিচ্ছেন গ্রামবাসী; প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে। প্রার্থনা একটাই– ‘ঘরের মেয়ে’ যেন বিজয়ী হয়।
তামিলনাড়ুর ছায়া-সুনিবিড় থুলাসেন্দ্রাপুরম গ্রামে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে জন্ম নিয়েছিলেন কমলা হ্যারিসের নানা পিভি গোপালান। চেন্নাই থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের এই অখ্যাত গ্রামই এখন শিরোনামে।
কমলার মা শ্যামলা গোপালনের নিবিড় যোগসূত্র নেই এই গ্রামের সঙ্গে। আর সেভাবে দেশে ফেরেনি গোপালন পরিবার। কিন্তু থুলাসেন্দ্রপুরমের বাসিন্দারা মনে করে, কমলা হ্যারিস তাদের ঘরেরই মেয়ে।
মঙ্গলবার সকালে মন্দিরে কমলার জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। তিনি জিতলে বিশেষ উৎসব উদযাপনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২০ সালে কমলা জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর গ্রামের বাসিন্দারা উৎসবে মেতেছিলেন।
কমলা হ্যারিসের ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে গ্রামের রাস্তাঘাট। কমলা হ্যারিস একবার জানিয়েছিলেন, তিনি দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাই তাঁর পছন্দের রান্নাও খাওয়াচ্ছে গ্রামবাসী।
কমলা হ্যারিস জিতলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। আর তখন ইতিহাসের পাতায় উঠবে ভারতের এই অখ্যাত গ্রামের নাম। সেই আশাতেই বুক বাঁধছেন থুলাসেন্দ্রপুরমের বাসিন্দারা।