সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২ বছরে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে।
নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। অধিকাংশ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছে। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা রোধে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।
আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনাখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ৩৪টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। র্যাবের প্রতিবেদনে ঢাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এ দুই এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুনাখুনি, মাদক, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মিরপুর এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। প্রথমে তুচ্ছ এবং পরে বড় অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে। গডফাদাররা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নতুন বছরের শুরুতে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে একাধিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এরই মধ্যে ঢাকার পাড়ামহল্লার কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তালিকা ধরে র্যাবও অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। অতীতে এ বিষয়ে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। সম্প্রতি র্যাবের পক্ষ থেকে অনেক কাজ করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক গ্যাং সদস্যদের সংখ্যা, নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শাহ আবিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, যখন যেখানে কিশোর গ্যাং সক্রিয় থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এছাড়া এ বিষয়ে আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ আছে, সেটি নিয়েও কাজ করছি।
খুনাখুনি চলছে : এ বছর ৩০ আগস্ট ঢাকার ওয়ারীতে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক কিশোর মুন্নাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সবুজবাগে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে কিশোর জব্বারকে খুন করা হয়। ২০১৯ সালের ২১ মার্চ উত্তরখানে ‘বিগ বস’ এবং ‘কাশ্মীরি’ গ্রুপের সংঘর্ষে কামরুল হাসান হৃদয় খুন হয়। ওই কিশোর ‘বিগ বস’ গ্রুপের সদস্য ছিল। শুধু তিনটি ঘটনা নয়, দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, আগে ঢাকার শিশু আদালতে শিশু-কিশোরদের মামলার বিচার হতো। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে। ঢাকার শিশু আদালতে ২০১৮ সালের ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৬টি খুনের মামলার বিচারকাজ চলে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে এসব খুনের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী দুই বছরে ঢাকায় আরও ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় আদনান কবির হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে। ওই সময় রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। এর কিছুদিন পর অভিযানে ঢিলেঢালা ভাব শুরু হয়। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় দুই বছরে তাদের হাতে ৩০টির বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক সংশ্লিষ্টতা : একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কিশোর অপরাধীদের একটা বড় অংশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান জীবনযাপন করে। রেললাইন ও বস্তি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত। বিশেষ করে মাদক, ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে তারা জড়িত।
র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। এর মধ্যে উত্তরায় ২২টি ও মিরপুরে ১০টি গ্যাং সক্রিয়। এছাড়া তেজগাঁও, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মহাখালী, বংশাল, মুগদা, চকবাজার ও শ্যামপুরে একাধিক গ্যাং সক্রিয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি ও ইভটিজিং এবং মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় সমাজের কিছু ‘বড় ভাই’ রয়েছে।
জানা গেছে, গ্রেফতার কিশোরদের দেশের তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। অধিকাংশ কিশোরই হত্যা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরক, নারী ও শিশু নির্যাতন, পর্নোগ্রাফি, তথ্যপ্রযুক্তি মামলার আসামি।
র্যাব জানায়, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত র্যাবের হাতে ২৯২ জন কিশোর অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ছিনতাইকারীদের বড় অংশই কিশোর। তারা শুধু ছিনতাই নয়- ডাকাতি, মাদক ও চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত।
গত বছরের মাঝামাঝি সময় রাজধানীর উত্তরা থেকে ‘ফার্স্ট হিটার বস’ বা ‘এফবিএএইচ’ নামে কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। মাদক সেবন, র্যাগিং, ছিনতাই এবং অশ্লীলতার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত ছিল।
সূত্রাপুর থেকে মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে লেজ টু পেজ নামে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের আগস্টে কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, রেললাইন বস্তিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪৬ জনকে কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪২ কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।
বিশেষজ্ঞ মতামত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে।