সংগীতশিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনামে আসেন। সামাজিক মাধ্যমে তার অপকর্ম নিয়ে চলে নেটিজেনদের সমালোচনা। এবার এ কণ্ঠশিল্পীর বিরুদ্ধে সাত মাস ধরে এক কলেজছাত্রীকে আটক রেখে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিয়োগ উঠেছে। গত সোমবার রাতে (১৯ মে) ডেমরা থানার পুলিশ মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ডেমরার একটি বাসা থেকে নোবেলকে আটক ও মেয়েকে উদ্ধার করে।
এক উদীয়মান সংগীতশিল্পী ছিলেন নোবেল। খুবই সম্ভাবনাময় একজন শিল্পী তিনি। কলকাতার চ্যানেল জি বাংলার ‘সারেগামাপা’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন নোবেল। তবে ব্যক্তিগতজীবনে মাদকসেবন, স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, কনসার্টে মদ্যপ অবস্থায় ওঠার পাশাপাশি সিনিয়র গায়কদের নিয়ে ফেসবুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেওয়া কেন্দ্র করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন এ কণ্ঠশিল্পী। এসবে মধ্যে জড়িয়ে কয়েকবার জেলেও খেটেছেন তিনি।
মাঈনুল আহসান নোবেল এক নারীকে সিঁড়ি দিয়ে টেনে নামাচ্ছেন—এমন একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিও দেখে মেয়েটির মা-বাবা তাকে চিনতে পারেন। পরে তারা জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে ঘটনা জানান। গত সোমবার (১৯ মে) রাত ১০টার দিকে পুলিশ ডেমরার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে।
পুলিশের ডেমরা থানার ওসি মাহমুদুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, গত নভেম্বরে এক ছাত্রীকে গুলশানে দেখা করার কথা বলে নোবেল তাকে ডেকে আনেন। তাকে বিয়ের আশ্বাস দেন। পরে সাত মাস ডেমরার একটি বাসায় তাকে আটকে রাখা হয়। এই সময়ে তিনি ওই ছাত্রীকে নির্যাতন ও নিয়মিত ধর্ষণ করেন। এসব ঘটনা নোবেল নিজের মুঠোফোনে ধারণ করেছেন। সেই ভিডিও দিয়ে ইডেনের ওই ছাত্রীকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করেছিলেন বলে দাবি পুলিশের।
পরে ১৯ মে রাতে নোবেলকে ডেমরা থেকে আটক করা হয়। ডেমরা থানার ওসি মাহমুদুর রহমান দাবি করে বলেন, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নোবেল সীমান্ত দিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ জন্য তিনি একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করেছিলেন। তবে পালানোর আগেই তাকে আটক করা হয়। নোবেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ছাত্রীটিকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগে আলোচিত এই শিল্পীর বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনেও মামলা হয়েছে। ভিকটিম ওই নারী শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে’ চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন ওসি মাহমুদুর রহমান।
এদিকে একটি গণমাধ্যমকে নোবেলের আইনজীবী মো. জসিমউদ্দীন বলেন, আদালতে নোবেলের বিরুদ্ধে যে ঘটনা দেখানো হয়েছে, তা সাত মাস আগের। প্রকৃতপক্ষে এ মামলার বাদী নোবেলের বিবাহিত স্ত্রী। তারা গত বছরের ২৪ নভেম্বর স্বেচ্ছায় পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছেন। মেয়েটি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হয়তো পারিবারিক মনোমালিন্যের কারণে সে মামলা করেছেন। আসামি বাদীর সঙ্গে সংসার করতে চান। আপসের শর্তে বা বাদীর জিম্মায় জামিন দিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
এর আগে ঘটনা ২০১৯ সালের। ‘সারেগামাপা’ অনুষ্ঠানে চ্যাম্পিয়ন হবেন বলে তার ভক্তরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তাকে তৃতীয় ঘোষণা করে জি বাংলা কর্তৃপক্ষ। ওই ঘটনায় বিচারকের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন নোবেল। তিনি বলেছিলেন, তার গান বিচার করার ক্ষমতা বিচারকদের নেই। এ ঘটনায় জি বাংলা চ্যানেল তাকে সাসপেন্ড করেছিল।
কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল— কেবল বিচারকদের সঙ্গেই নয়, অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গেও তিনি নাকি নাক–উঁচু ভাব নিতেন। কাউকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না।
এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কেমব্রিজ স্কুল ও কলেজ থেকে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল সম্পন্ন করা নোবেলের বিরুদ্ধে প্রথম ধর্ষণের মামলা হয় ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের এক তরুণী পাঁচলাইশ থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
সেই মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই সেই বছরের ১৫ নভেম্বর সালসাবিল মাহমুদকে ভালোবেসে বিয়ে করেন নোবেল। পরে দুজনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘটনা ঘটে। দুজনই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। একপর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তাদের।
সাবেক স্ত্রী সালসাবিলের সঙ্গে বিয়ের আগে ও পরে বিভিন্ন সময় অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর গুঞ্জন ছিল নোবেলের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। সালসাবিলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল গণমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, আপাতত বিয়েশাদি নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
এরপর ২০২৩ সালের ২০ মে নোবেলকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে নেওয়া হয়। ওই সময় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন— নোবেলের বিরুদ্ধে তার স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এর আগে ২৭ এপ্রিল মদ্যপ অবস্থায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে একটি কনসার্টে উঠেন। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং আচরণ অনিয়ন্ত্রিত থাকায় দর্শকরা বুঝে যান, তিনি মদপান করে স্টেজে উঠেছেন। পরে উত্তেজিত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে তার ওপর পানির বোতল ও জুতা ছুড়ে মারেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আয়োজকরা তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নেন।
পরে এ বিষয়টি নিয়ে তার সাবেক স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন— নোবেলের ওই কাণ্ডে তিনি অবাক হয়েছিলেন। কীভাবে বদলে গেলেন তিনি।
এদিকে বেশ কয়েকবার মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি পর্যন্ত হয়েছিলেন নোবেল। কিন্তু নিরাময়কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গানে ফিরবেন বলে বিভিন্ন সময় তার ভক্তদের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন এ সংগীতশিল্পী। কিন্তু এ গায়ক কোনো প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি।
বিতর্ক পিছু ছাড়েনি নোবেলের। জাতীয় সংগীত এবং এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। জেমসকে নিয়েও বাজে মন্তব্য করে সংবাদের শিরোনাম হন নোবেল।
এর আগে ফেসবুকে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে সংগীতশিল্পী নোবেলের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১ জুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৫(২)২৯ ধারায় মামলা করেছিলেন জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইথুন বাবু।
তিনি অভিযোগ করেছিলেন, নোবেল তার ফেসবুক পেজ ‘নোবেল ম্যান’ থেকে দেওয়া এক পোস্টে ইথুন বাবুকে চোর বলেছেন। ওই পোস্টে নোবেল লিখেছেন— ‘ইথুন বাবু একটা চোর। অন্যের গান নিজের নামে চালায় দিয়েছে।’ এ কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে নোবেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন ইথুন বাবু।
২০২১ সালের ১৭ মে সময় টিভির বিনোদন সাংবাদিক আল কাছির তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করলে নোবেল ক্ষুব্ধ হন। পরে ওই সাংবাদিককে ফোন করে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘নোবেলকে তুই চিনিস? নোবেল কী শিল্পী? নোবেল কিন্তু ক্যাডার।’ শুধু তা-ই নয়, সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে সেই রিপোর্টারকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসারও হুমকি দেন নোবেল।
হুমকি পেয়ে সেই দিন সময় টিভির প্রশাসন ও পরিচালন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সৈয়দ আসাদুজ্জামান ঢাকার কলাবাগান থানায় নোবেলের বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন।
পরে জিডির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে সাংবাদিকরা নোবেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কিসের জিডি হইছে? ও জিডি-মিডি দেহে নেব নে।’
ওই ঘটনার জেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, নোবেল সাংবাদিক আল কাছিরকে অপহরণের হুমকি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গালাগালও করেছেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি নোবেলকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, কোনোভাবেই তার এমন আচরণ মেনে নেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে যদি কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে এমন অন্যায় আচরণ করেন, তবে নোবেলকে বর্জনের হুমকি দেয় বিনোদন সাংবাদিকদের সংগঠনটি।
এই কেলেঙ্কারির পরও নোবেল নিজেকে সংশোধন করতে পারেনি। মাদক থেকে মুক্তি এবং নিজের জীবনের ব্যাপারে ফেসবুকে অনুশোচনা করে স্ট্যাটাস পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর ফেসবুকে এক নারীর সঙ্গে তিনি তিনটি ঘনিষ্ঠ ছবি পোস্ট করেন। সেখানে লেখেন— মেয়েটি তার স্ত্রী। খুলনার মেয়েটি ছিলেন ফারজানা আরশি। পেশায় ফুড ব্লগার। পরে জানা যায়, নোবেলকে বিয়ের আগে আরশির নাদিম আহমেদ নামে এক ফুড ব্লগারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়ের দুই বছর পর ভেঙে যায়। পরে ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে নোবেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় আরশির। এ বিয়েও বেশি দিন টেকেনি। বিয়ের সপ্তাহখানেকের মাথায় নোবেল ভর্তি হন মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে।
এদিকে আরশি চলে যান খুলনায়। সেখানে গিয়ে ফেসবুকে তিনি অনুশোচনা করে লেখেন— আমি আমার বাড়ি খুলনাতে আছি। না জেনে উল্টোপাল্টা খবর ছড়াবেন না, প্লিজ। আজকে যদি আমি নাদিমের সঙ্গে সব কিছু শেষ করে যেতাম, তাহলে কেউ কিছুই জানতে পারত না। আমি কি এতটাই বোকা? আমি জানি না যে নোবেল এই ছবি পোস্ট করলে কতটা ঝামেলা হবে? বিশ্বাস করেন, এসবে আমার হাত ছিল না।
নোবেলের সেই বিয়ের খবর গণমাধ্যমে আসার আগের স্ত্রী সালসাবিল ফেসবুকে লেখেন—খুলনার একজন ফুড ব্লগার নাদিম আহমেদের সঙ্গে সাত বছরের প্রেম ছিল তার স্ত্রী আরশির। ২০২১ সালের শুরুতে তারা বিয়ে করেন। দুই বছরের সংসার তাদের। সেসব বাদ দিয়ে নোবেলের কাছে চলে এসেছে মেয়েটি।